(CLICK ON CAPTION/LINK/POSTING BELOW TO ENLARGE & READ)

Monday, February 25, 2013

আসলে আপনারা নিজেরা ভয় পেয়েছেন |



আসলে আপনারা নিজেরা ভয় পেয়েছেন |

মানব মুখার্জি

১ আপাতত ছাত্র সংসদ নির্বাচন এরাজ্যে বন্ধ। মুখে যাই বলা হোক, আসলে গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজের ঘটনার পরবর্তী তৃণমূলী দাওয়াই এটাই। মুন্নাভাইরা মুক্ত থাকবে, ‘দাদা’ ববি হাকিম মন্ত্রী থাকবে, কাটা যাবে বেচারি ছাত্রদের নিজস্ব সংসদ গড়ার অধিকারটুকুও।

এ প্রশ্নে এক অভূতপূর্ব মতের ঐক্যও গড়ে উঠেছে। তৃণমূল-রাজ্যপাল-আনন্দবাজার-বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ-প্রাক্তন পুলিস কর্তা সবাই। তৃণমূলের চোখে এখন কলেজগুলোও টাকা কামানোর উর্বর ক্ষেত্র। যেখানে ভবিষ্যতের বড় তোলাবাজরা হাত পাকাবে। ৭২-’৭৭-এর মহান ঐতিহ্য ৩৪ বছর ‘দমবন্ধ’ করা অবস্থা কাটিয়ে আবার বর্ধিত মহিমায় ফিরে আসছে। অ্যাডমিশন থেকে পরীক্ষার নম্বর — প্রায় ছাপানো রেট কার্ড দিয়ে টাকা আদায় হয়। ফলত ছাত্র সংসদ নির্বাচন এখন সোনার খনির দখলের প্রতিযোগিতা — গুলি, গোলা, বোমা এখন কলেজের গেটে ‘ন্যায়সঙ্গত’ হাতিয়ার। বসুন্ধরা এবং তোলা দুটোই বীরভোগ্যা — কাজেই ছাত্র সংসদ দখল হবে। নির্বাচনের কথা বলে কোন্‌ অর্বাচীন? এখন নতুন ফতোয়ার মাধ্যমে ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচন’ নামক বিধিবদ্ধ আপদটিকে বিদায় করা গেল, ‍কিন্তু তোলাবাজি অটুট থাকবে। কারণ এই কাজটি তত্ত্বাবধান করার জন্য কলেজগুলোর পরিচালন কমিটির মাথায় এনে বসানো হয়েছে ববি-আরাবুল-বেচারাম এবং সমতুল্য তৃণমূল নেতাদের। আর সব মিলিয়ে কলেজ ছাত্র সংসদ একটু বিপজ্জনক বটে। কোনোভাবে যদি সত্যি সত্যি একটি নির্বাচন হয়ে যায় তবে এরাজ্যে একটি কলেজেও তৃণমূল কংগ্রেস জিতবে না। এইসব গণতন্ত্রের ফ্যাচাং করে জমিদারি হাতছাড়া করার রিক্স নেওয়া যায় না।

গার্ডেনরিচ ঘটনায় মাননীয় রাজ্যপালের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াও তাই — বন্ধ করে দাও ছাত্র সংসদ নির্বাচন। পরাধীন দেশে ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন দেশনেতারা — এঁরা কি সব নির্বুদ্ধি ছিলেন? এ কথা ঠিক সেই নেতারা যখন ক্ষমতায় এলেন প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের চক্ষুশূল হয়েছিলো। ছাত্র সংসদ নির্বাচন বাতিল করার দাওয়াই-এর পেছনে আসল লক্ষ্য হলো — শিক্ষিত তরুণ সমাজকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাজনীতি দেশের ভবিষ্যত রাজনীতি এবং ভবিষ্যতের রাজনীতিকদের তৈরি করে। মহামান্যরা ঠিক কি চান? রাজনীতিতে আসুক মুন্নাভাই, আরাবুল ইসলাম এবং তাদের দলবলেরা — শিক্ষিত নীতি বোধসম্পন্ন তরুণেরা যাতে না আসে। একজন রাজনীতিককেও কিছু জিনিস শিখতে হয়, কিছু জিনিস বুঝতে হয় — তারও একটা শিক্ষা‍‌নবিশী প্রয়োজন। সমস্যা হলো রাজনীতি সবাই করে। সমাজবিরোধী, ফাটকাবাজ, প্রাক্তন পুলিস-আমলা সহ সবাই। কারণ রাজনীতি এদের কাছে ক্ষমতা। রাজনীতির রাজটা তারা বোঝেন, সঙ্গে নীতি বলে একটা কথা আছে সেটাকে এরা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। ক্ষমতার লোভটা সহজাত, কিন্তু নীতিবোধটা শিখতে হয়, প্রয়োগ করা জানতে হয়। এই শেখার ক্ষেত্রটিকে অপ্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করার চেষ্টা হচ্ছে।

(২)

যেই সমস্যার থেকে এই ফতোয়া, আর প্রকৃত চরিত্র এবং সমাধানের রাস্তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। সমাজবিরোধীদের মুক্তাঞ্চল হয়ে গেছে গোটা রাজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বা বাদ থাকবে কেন। সমাজবিরোধী দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যাবে না, তাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া হলো। সমাজবিরোধীদের নিরাপদ এবং তরতাজা রাখাটাই এ রা‍‌জ্যের সরকারের প্রধান কাজ, তাতে অন্য কিছু বিসর্জন দিতে হলেও কোনো অপরাধ নেই। ভারতীয় রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন কোনো নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় বিষয়টা একটি অন্য মাত্রা নিয়েছে। এখানে সরকার, সরকারী দল এবং সমাজবিরোধীরা কাজ করছে এমনভাবে, যে অনেক ক্ষেত্রে এগুলোকে আলাদা করা যাচ্ছে না। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ — গার্ডেনরিচের ঘটনা। প্রথমত, যেটা বোঝা দরকার তা হলো — গোটা ঘটনাটা নিছক একটি কলেজ ইউনিয়ন দখল করার জন্য করা হয়নি। উদ্দেশ্য ছিলো আরও বড়। রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা তৃণমূল, সামনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপনির্বাচন। পুলিস অফিসার তাপস চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হবার পর অবতীর্ণ হলেন মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ আস্থাভাজন ববি হাকিম। তিনি ঐ কলেজের পরিচালক কমিটির চেয়ারম্যান, স্থানীয় বিধায়ক এবং মুন্নাসহ বাকি মাফিয়া নেতাদের গডফাদার। তিনি প্রথমেই মিডিয়ার সামনেই সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করে জানালেন পনেরো মিনিটের মধ্যে তিনি গোটাটা সামলে নেবেন। তারপর মিডিয়ার কাছে তার বিবৃতি — গণ্ডগোল করেছে ‘কংগ্রেস এবং সি পি এম-এর একাংশ।’ শুধু তাই না সি পি এমের পার্টি অফিস থেকে বোমাসহ দুজন ধরা পড়েছে। ঘটনা হলো, কলেজের প্রায় উল‍‌টো দিকেই সি পি আই (এম)-এর জোনাল কমিটি অফিস। এবং সি পি আই (এম) অফিস থেকে অস্ত্র বা বোমা উদ্ধারটা মমতা ব্যানার্জির আমলে সবচেয়ে সহজ কাজ। আর যারা টিভি দেখেছেন তারা লক্ষ্য করবেন গুলিটি চালানো হলো উলটো দিকে মুখ করে। অর্থাৎ মনে হবে গুলিটি এসে‍‌ছে মোক্তারের লোকজন বা কংগ্রেসের জমায়েতের দিক থেকে। তাহলে বিষয়টা দাঁড়ায় এরকম সি পি এম অফিস থেকে বোমা উদ্ধার এবং কংগ্রেসের জমায়েত থেকে গুলি — নিহত পুলিস অফিসার। চিত্রনাট্য তৈরি। বাধ সাধলো টিভি ক্যামেরা—তারা গোটাটা তুলেছিলো। কিন্তু ববি হাকিম যখন মিডিয়াকে বলছেন, তখন তিনি এটা জানেন না। এই গোটা চিত্রনাট্যের প্রধান চরিত্র কেবল ববি হাকিম এবং মুন্না ভাইয়ের লোকজনরা নয়। পুলিসকেও একটা ভূমিকা পালন করতে হয়। আর সবাই দেখেছে হত্যাকারীকে ধরেও পুলিস ছেড়ে দিলো। সমাজবিরোধীরা সশস্ত্র আর পুলিস সবসময় নিরস্ত্র থাকবে, এতো খোদ মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত। 

(৩)

মমতা ব্যানার্জি এবং তৃণমূলের মতো সব প্রশ্নে অধঃপতিত একটি রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় আসে তখন সেখানে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বা দায়বদ্ধতা প্রত্যাশা করা যায় না। পুলিস প্রশাসনকে ব্যবহার করার চেষ্টা হচ্ছে এমনভাবে যেন সেটা তৃণমূল কংগ্রেসের একটি শাখা সংগঠন। এর একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলার সামগ্রিক অধঃপতনের মধ্যে। প্রথমে, সি পি আই (এম) এবং বামপন্থী দলগুলোর বিরুদ্ধে সামগ্রিক হামলা চালানোর জন্য সমাজবিরোধীদের লাইসেন্স দিল পুলিস। পরে হামলাবাজি প্রসারিত হলো অন্য সব ক্ষেত্রে। কিন্তু সমাজবিরোধীদের একবার লাইসেন্স দিলে সেই লাইসেন্স আর প্রত্যাহার করা যায় না।

সমাজে মানুষের দুটি ভাগ। এক, আইন মেনে চলা সাধারণ মানুষ; দুই, আইন ভাঙতে চাওয়া সমাজবিরোধী। পুলিসের কাজ আইন রক্ষা করা অর্থাৎ সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা। ভবানীপুর থানা আক্রমণ করলো তৃণমূলীরা। উপলক্ষ্য তাদের জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানের মিছিলকে ক্যানসার হাসপাতালের সামনে মাইক বন্ধ করার আইনসম্মত পুলিসী অনুরোধ। থানা আক্রমণকারীদের পুলিস লকআপ থেকে নিজে মুখ্যমন্ত্রী মধ্যরাতে গিয়ে ছাড়িয়ে আনলেন এবং বারো ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারকারী পুলিস অফিসারদের বদলি করে দিলেন। এর মধ্যে দিয়ে দু’পক্ষকেই পরিষ্কার বার্তা দিয়ে দেওয়া শুরু। সমাজবিরোধীদের জানিয়ে দেওয়া গেল — আমরা তোমাদেরই লোক। আর পুলিসকেও বোঝান গেল কাদের পক্ষে তাঁদের দাঁড়াতে হবে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হলো, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো সাধারণ আইন-শৃঙ্খলা। আর বাড়তি উপসর্গ হিসাবে দেখা গেলো পুলিসের ওপর তৃণমূলী সমাজবিরোধীদের হামলার স্রোত — সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠলো গার্ডেনরিচ হত্যাকাণ্ডে। 

কিন্তু এই রাজ্যে পুলিসের সামনে যে সঙ্কট সেটা অল্পবিস্তর সব রাজ্যের প্রশাসনের সামনেই। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন এবং দুর্নীতি যত বাড়ছে পুলিস এবং সাধারণ প্রশাসনের সামনে এই প্রশ্নটা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে — কাকে সন্তুষ্ট করবে, আইনকে না দুর্বৃত্ততুল্য রাজনৈতিক নেতাদের। সরকারের নির্দেশ মেনেই প্রশাসন এবং পুলিসকে চলতে হয়। কিন্তু তারা কিভাবে কাজ‍‌ করবে — তা নিয়ে আইনেও পরিষ্কার নির্দেশ আছে। যে রাজনৈতিক নির্দেশ আইন মোতাবেক না — তাকে মেনে চলতে কেউ বাধ্য নয়। কিন্তু এটাও ঠিক নির্দেশ না মানলে সরকারের রাজনৈতিক রোষের মুখে পড়তে হবে; কি করবেন প্রশাসকরা? একটি সহজ রাস্তা পালানো। এরাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর টেবিলে এসে জমা পড়ছে একের পর এক আই এ এস, আই পি এস অফিসারদের দিল্লিতে ‘পালানোর’ আবেদন। সংখ্যাটি প্রায় রেকর্ড-এর পর্যায়ে উঠেছে।

এটা সব সময়ের জন্য সত্য — যিনি দক্ষ এবং যোগ্যতাসম্পন্ন তার রাজনৈতিক আনুকূল্যের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যোগ্যতাহীনরাই রাজনৈতিক নেতাদের চারিদিকে ভিড় করে আনুকূল্য পেতে। এবং এরা তা পায়, ফলত সরকারী মন্ত্রীদের অপদার্থতার ভারকে আরও বাড়িয়ে দেয় এই অযোগ্য সরকারী কর্তারা। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীকে খুশি করতে তৎকালীন পুলিস কমিশনারের বিবৃতি — গোটা ঘটনাটি সাজানো। এর মূল্য হলো দময়ন্তী সেনের বদলি এবং কলকাতা পুলিসের অধঃপতন। এখন দেখা যাচ্ছে দেশ কাঁপানো দুর্নীতিগুলোর জন্য যত রাজ‍‌নৈতিক নেতা অভিযুক্ত হচ্ছেন, তার থেকে বেশি হচ্ছেন সহযোগী আমলারা। আবার বিপরীত চিত্রও আছে — নরেন্দ্র মোদীর সংগঠিত দাঙ্গা এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা নিয়েছেন বেশ কয়েকজন আই পি এস অফিসার।

পশ্চিমবাংলার অনুরূপ উদাহরণ কম, বরং আত্মসমর্পণের চিত্রটি বেশি। আনন্দবাজার বিদায়ী পুলিস কমিশনারের মধ্যে যতই ‘বীরত্ব’ আবিষ্কার করুক, আসলে তিনি আত্মসমর্পণেরই পথপ্রদর্শক। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির পুজোয় খালি পায়ে ঘুরে বেড়ানো পুলিস কমিশনারকে দেখে পুলিস বাহিনী হতোদ্যমই হয়। বিরোধী দলের সাথে বাক্যালাপ বন্ধ করা স্রেফ রাজনৈতিক বসদের খুশি করার জন্যই। এমনকি গার্ডেনরিচ কাণ্ডেও তার দৃঢ়তার অভাব ফুটে বেরিয়েছে। চোখের সামনে নিরস্ত্র সহকর্মীর অসহায় মৃত্যু সাধারণ পুলিসের মধ্যে বিদ্রোহের কারণ হতে পারে। এটা ঠেকাতেই মুন্নাভাইয়ের নামটি এফ আই আর-এ দিতে বাধ্য হয় পুলিসকর্তারা। ব্যস ঐ পর্যন্ত। পরের দিন মুন্নাভাই ওরফে ইকবাল বুক ফুলিয়েই ঘুরে বেরিয়েছে, কর্পোরেশনের বোরো অফিসে দীর্ঘ সময় ধরে ববি হাকিমের সাথে মিটিং করেছে, সবকিছুই স্বাভাবিক — মুখ্যমন্ত্রী দীঘার সমুদ্র সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পরিস্থিতি পালটে গেল, জনরোষের বিস্ফোরণে এবং রাজ্যপালের মন্তব্যে। মুখ্যমন্ত্রী ফিরে এলে ইকবালকে আত্মগোপন করার নির্দেশ দেওয়া হলো — কারণ সরকারকে কিছু করতেই হবে। মুখ্যমন্ত্রীর সামনে একটাই পথ খোলা — কারুর একজনের মাথা কাটতেই হবে। কে হবে সেই হতভাগ্যটি। দুজনের মধ্যে একজন — ববি অথবা নগরপাল। ববি তার কাছে অনেক মূল্যবান। অতএব বাবুর হাতে পারিষদের মুণ্ডচ্ছেদ। অভিমানে বরখাস্ত আই পি এস টি ছুটি নিলেন — এত কিছু করার পর এই পুরস্কার! বরং এই ছুটিতে উনি বসে ভাবতে পারবেন — কি হতো যদি প্রথম থেকেই একজন নির্ভীক পুলিস অফিসার হয়ে তার বাহিনীর সম্মান এবং মনোবল বজায় রাখতে পারতেন? গুজরাটের সঞ্জীব ভাট হতে হবে না, অন্তত যদি দময়ন্তী সেনও হতে পারতেন। নীতিহীন আত্মসমর্পণের জন্য প্রতিদিন আদালতে পুলিস বেআব্রু হচ্ছে। রাজনৈতিক দল নয় — রাষ্ট্রের আইনী স্তম্ভটিই দেখিয়ে দিচ্ছেন আইন রক্ষার স্তম্ভটি কিভাবে অধঃপতিত হয়েছে।

সমস্যা সবচেয়ে বেশি সাধারণ পুলিসকর্মীদের। তাঁদের যাঁরা নেতৃত্ব দেন তাঁরা তাঁদের সবচেয়ে অসহায় জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দু’দিক থেকেই তাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন। কর্তারা যাই শেখাক আসলে তাঁরা বৃহত্তর সমাজেরই অংশ। সেই বৃহত্তর সমাজ তাকে কোন্‌ চোখে দেখছে এটাও গুরুত্বপূর্ণ। সরকার তাঁকে পাঠাচ্ছে ধর্মঘট ভাঙতে। যে ধর্মঘট ডেকেছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। পুলিস উর্দি খুলে ঘরে ফিরলে এই ধর্মঘটীরাই তার প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মীয়। অথচ সেই সরকারই তাঁকে অসহায়ভাবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে সমাজবিরোধীদের হামলার সামনে। সামাজিক প্রত্যাশা, সে এই সমাজবিরোধীদের প্রতিহত করুক। রক্ষা করুক সাধারণ মানুষকে। দুদিক থেকেই পুলিস তার সামাজিক অবস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। এই বিচ্ছিন্নতা নিয়ে সে বেশি দিন চলতে পারে না। পুলিসকেও ভাবতে হবে। এবং এই ভাবনা কোনো একজনের ভাবনা না, সামগ্রিকভাবেই ভাবতে হবে — তারা কি করবে। সমাজবিরোধীদের কোন রাজনৈতিক চরিত্র থাকে না। থাকে অর্থনৈতিক লক্ষ্য। আইন এড়িয়ে, আইন ভেঙে সে আর্থিক লাভ করে। অথচ সরকার এবং সরকারী দলের থাকে প্রধানত রাজনৈতিক লক্ষ্য। সরকারী নেতাদের নিজেদের আর্থিক লাভটি আনুষঙ্গিক বিষয়। আইনের রক্ষক যখন সমাজবিরোধীকে আইন ভাঙতে দেয়—তারও থাকে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। সমাজবিরোধী বোঝে এই সরকার থাকলেই তার লাভ—সে করে খেতে পারবে। তার নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থেই এই সরকারকে রাখা দরকার। যে ছিলো রাজনৈতিক লক্ষ্যহীন সমাজবিরোধী সে এর মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠে সরকারের কট্টর সমর্থক। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন কেবল না, এটা দুর্বৃত্তের রাজনীতিকরণ। প্রতিটি পাড়াতে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তৃণমূলের কট্টর সমর্থক এক দল ‘করে খাওয়া’ দঙ্গল। এরাই শাসক দলের ভৈরববাহিনী, ‘তাজা’ ছেলেদের দল, দিদির একনিষ্ঠ ভক্তবৃন্দ।

অথচ কুড়ি মাস আগে এই তৃণমূলই বিপুল সমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিলো। তাদের নিয়মিত সমর্থক ছাড়িয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশের নতুন সমর্থন পেয়েছিলো তারা। একটি গণতান্ত্রিক দলের স্বাভাবিক প্রবণতা হবে—এই বাড়তি সমর্থনকে যে কোনো ভাবে ধরে রাখা। কিন্তু তৃণমূল একদিনের জন্যেও সেই চেষ্টা করেনি। মুখের সামনের মাছিকে যেভাবে একজন চরম অবজ্ঞা নিয়ে তাড়ায় তৃণমূল তাদের জোটসঙ্গীদের এবং নতুন সমর্থকদের এক অংশকে সেভাবেই তাড়ালো। তৃণমূলের সঙ্গে থাকার পূর্বশর্ত—বিনা বাক্যে তাদের এবং তাদের নেত্রীকে মেনে চলতে হবে। একটি স্বাভাবিক দল যে কাজ করে তৃণমূল ঠিক তার উলটো কাজ করলো। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সি পি আই (এম) আপ্রাণ চেষ্টায় তার সহযোগীদের ধরে রেখেছিলো ৩৪ বছর, এমনকি এখনও—তৃণমূল সে পথে হাঁটেনি। সে সংগঠিত করেছে এই নীতিহীন, অন্ধ, সমাজবিরোধী বাহিনী। এটিই পৃথিবীর সমস্ত স্বৈরাচারীদের বৈশিষ্ট্য। মুসোলিনির ব্ল্যাক শার্টস, হিটলারের ব্রাউন শার্টস, ৭০-৭৭-এ কংগ্রেসের ‘যুগ যুগ জিও বাহিনী’, আর এখন তৃণমূলের ভৈরববাহিনী। সংগঠিত সমাজবিরোধী সমর্থনের ভিত্তিতে আরো ক্ষয় করবে জেনেও তারা এই কাজ করে—কারণ তারা মনে করে জয়ের অস্ত্রে সমস্ত বিরোধীতাকে তারা দমন করে দেবে। গণতন্ত্রকে কোন সুযোগ না দেওয়াই এদের প্রধান রাজনৈতিক দর্শন। এটা এরকম নয়, একটি খারাপ দল, একজন খারাপ নেত্রী হঠাৎ ক্ষমতায় এসে গেছে। এটি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রবণতা—যার নাম স্বৈরাচার। লড়াইটা কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয় লড়াই স্বৈরাচারী রাজনীতির বিরুদ্ধে। এরা গণতন্ত্রের সামান্যতম বহিঃপ্রকাশকে সহ্য করতে পারে না—তার বিরুদ্ধে এদের অস্ত্র এই সংগঠিত সমাজবিরোধী বাহিনী। আগামী দিনে এরাজ্যে প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং কার্যকলাপ আক্রান্ত হবে। কারণ এই গণতন্ত্রকে তারা ভয় পায়। উদাহরণ হিসাবে ২০-২১শে ফেব্রুয়ারির সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটটি একটি আদর্শ উদাহরণ।

দাবিগুলো ছিলো সর্বভারতীয় এবং প্রধানত কেন্দ্রের সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু কেন্দ্র কিছু বলার আগেই সেই ধর্মঘটের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজ্যের সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে এবং নির্দেশে। কোনো কিছুর বিরুদ্ধাচারণ করার একটি স্টাইল আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর নিজস্ব — যাতে ভদ্রতা, সভ্যতা বা শিষ্টাচারের লেশ মাত্র থাকে না। এক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। তাঁর সর্বশেষ দাওয়াই — নিষিদ্ধ হোক ধর্মঘটী দল এবং ধর্মঘট। এই ধর্মঘটের বিরুদ্ধে ছিলো কেন্দ্রীয় সরকার, দেশের কর্পোরেটকুল এবং তাদের মিডিয়া। বোঝা গেলো বাইরে জোট ভাঙলেও, অর্থনীতির প্রশ্নে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের জোট অটুট আছে। এই জোটবদ্ধতার বাইরে তৃণমূল নেত্রীর একটি বিশেষ অবস্থান এর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হলো ধর্মঘট বা ধর্মঘটীদের নিষিদ্ধ করার ইচ্ছার মধ্যে। মুখ্যমন্ত্রী নিঃসন্দেহে কর্পোরেট এবং কর্পোরেট মিডিয়ার হাততালি কুড়োনোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার উচ্চারিত ইচ্ছাটির গভীরতা অনেক বেশি। ধর্মঘট নিষিদ্ধ করার বিষয়টি পৃথিবীর সমস্ত স্বৈরাচারের প্রথম পদক্ষেপ। গোটা পৃথিবীর স্বৈরাচার বা হিটলার এবং নাৎসি জার্মানির ইতিহাস মুখ্যমন্ত্রী সারা জীবন পড়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এমনকি রেল ধর্মঘট ভাঙতে গিয়েই এ দেশে জরুরী অবস্থার আগমন এটিও তার বিবেচনায় ছিলো বলে মনে হয় না। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর তার প্রয়োজনও হয় না — কারণ তিনি একজন স্বাভাবিক (organic) স্বৈরাচারি। তিনি তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি (instinct) দিয়েই বোঝেন তার ক্ষমতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সংগঠিত মানুষ। তিনি তার সর্বশক্তি দিয়েই তাই গণতন্ত্রের এই মূল ভিত্তিতে আক্রমণ করার চেষ্টা করেন। গত কুড়ি মাসে তিনি এবং তার দল ঠিক এই কাজটিই করার চেষ্টা করেছেন। ছাত্র সংসদ থেকে কো-অপারেটিভ, ট্রেড ইউনিয়ন থেকে স্কুল কমিটি। যেখানেই গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটা আছে সেটিকেই ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি অপছন্দের মিডিয়াও তার আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। প্রকাশ্যে এবং নেত্রীর অনুমোদন নিয়ে তৃণমূলের নেতারা বলে বেড়াচ্ছেন তাদের জমিদারিতে পঞ্চায়েতে কোনো বিরোধী দলকে প্রার্থী দিতে দেওয়া হবে না।

কুড়ি মাসে স্বৈরাচার তার এক একটি কুৎসিত পাপড়ি মেলে ধরছে বাংলার বুকে। সর্বশেষ ২০-২১শে ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট। গোটা দেশে এ জিনিস কখনও দেখেনি। একটি রাজ্য সরকার তার প্রশাসনের সমস্ত দাঁত ও নখ সহ ঝাঁপিয়ে পড়েছে ধর্মঘটীদের ওপর — সঙ্গে সহযোগী সংগঠিত সমাজবিরোধী সংবলিত তৃণমূল কংগ্রেস।

মুখ্যমন্ত্রী মাইনা কাটার সিদ্ধান্তে উজ্জীবিত কর্মীরা ধর্মঘটীর কান কেটেছে। রাজ্যে ‘ওয়ার্ক কালচার’ ফিরিয়ে আনতে তৃণমূল তাদের নিজস্ব কালচার দেখিয়েছে। হেডমাস্টারকে তার ছাত্রদের সামনে পিটিয়ে রোদে তিন ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়েছে। অটোচালক থেকে ইঞ্জিনিয়ার, সবজি বিক্রেতা থেকে ইঞ্জিনিয়ার কারোর রেহাই মেলেনি। তৃণমূল এবং তার সরকারের হাত ধরে বাংলা যাত্রা করেছে তালিবানি আফগানিস্তানের দিকে। নরক এক এক করে নতুন দরজা খুলছে বাংলার বুকে।

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে আমাদের জিজ্ঞাসা — এই করে কত দিন? খোঁজ নি‍‌লে জানতেন সমস্ত হুমকি সত্ত্বেও ধর্মঘট হয়েছে। আপনার ভয়ের চাবুক মানুষকে রাস্তায় নামাতে পারেনি। কারখানাগুলো খোলেনি, খোলেনি ব্যাঙ্কের দরজা, ইনস্যুরেন্সের গেট, কাজ হয়নি খনিতে, বন্দরে। মাস্টারমশাইদের মতো ছাত্ররাও আসেনি। খোকাবাবু সিনেমা বা পাগলুর নাচ দেখার ফাঁকে একটু-আধটু ইতিহাসও পড়া উচিত। পড়লে দেখতেন বিশ্ব রাজনীতিতে অনেক বড় মাতব্বর, অনেক বড় মাস্তানও এ পথে বিশেষ দূর এগোতে পারেনি। আর আপনি? হরিদাস পাল নামটি পুরুষের, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মহিলা। পারবেন না। স্বৈরাচারের বুটের তলায় গণতন্ত্র নিকেশ হয় না। আপনার কানকাটা ভৈরববাহিনী দিয়েও কিছু করাতে পারবেন না। ভয়ের মতো, ভয় ভাঙাটাও ছোঁয়াচে — দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছে গোটা বাংলা জুড়ে। আর গোটা দেশও এসে দাঁড়াচ্ছে বাংলার পাশে।

অন্ধকারের শক্তি এক পা এক করে নেমে আসছে বাংলার বুকে। অথচ কুড়ি মাস আগে বিপুল ভোট নিয়ে হাসিমুখে হাত নাড়তে নাড়তে রাইটার্সে ঢুকেছিলেন—আর আজ একটা কলেজের ছাত্রদের ভোটকেও পর্যন্ত ভয় পান, একটা গ্রামীণ সমবায়ের ভোটের খবরেও আপনার এবং আপনার দলের বুক কাঁপে। আপনি ধমকে ছাড়া কথা বলতে পারেন না। আপনার দল ভদ্রলোকের ভাষায় কথা বলতে ভুলে গেছে। আপনি হাসলে বোঝা যায়, আপনার হাসি মুখের পেশিতে। ভেতর থেকে আসে না। হিটলার তাও যুদ্ধ বাধিয়ে জার্মানিতে বেকারদের চাকরি দিয়েছিলো। মুসোলিনির আমলে ইতালিতে ট্রেন ঠিক সময় চলতো—আপনার এরকম কোন ‘কৃতিত্ব’ও নেই। আপনি উৎসবের নামে মোচ্ছব করতে পারেন, দীঘার সমুদ্র সৈকতে দলবল নিয়ে পায়চারি করতে পারেন, টালিগঞ্জের নায়িকাকে নিয়ে ধর্মঘটের দিন রাইটার্সের ক্যান্টিনে ধোসা খেতে পারেন, আর ভয় দেখাতে পারেন—আর কিছু করতে পারেন না। আপনি আর আপনার দল যত ভয় দেখাচ্ছে ততো বেশি বোঝা যাচ্ছে—আপনারা নিজেরা ভয় পেয়েছেন। এতোটাই ভয় পেয়েছেন যে, স্বাভাবিক বুদ্ধিও গুলিয়ে যাচ্ছে, যা করছেন সব ভুল। মুখ্যমন্ত্রী নাকি কুড়ি ঘণ্টা জেগে থাকেন, ঘুমোন মাত্র চার ঘণ্টা। ভয় এই বাকি চার ঘণ্টার ঘুমও ছুটে না যায়। একটি হিংস্র, স্বৈরাচার যখন ভয় পায় সে আরো বিপদ ডেকে আনে। এই বিপদের মধ্য দিয়েই রাজ্যকে যেতে হবে, মানুষের দুর্ভোগে চোখের জল পড়বে। কিন্তু কতদিন? মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ তার বিশ্বস্ত গণৎকারদের ডেকে জিজ্ঞাসা করুন—আর কতদিন? মনে হয় না শেষের সে দিন খুব দূরে আছে।

No comments:

Post a Comment