(CLICK ON CAPTION/LINK/POSTING BELOW TO ENLARGE & READ)

Thursday, April 11, 2013

AMBIKESH MAHAPATRA VS MAMATA BANERJEE


তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬-এ ধারা ও অধ্যাপক অম্বিকেশের হয়রানি|

দেবেশ দাস

১২ই এপ্রিল, ২০১২। রাত প্রায় ন’টা। সারাদিন ক্লাস-গবেষণার কাজ করে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র একটি সমবায় আবাসনে তার ফ্ল্যাটে ফিরছিলেন। তাঁর হেঁটে যাওয়ার রাস্তায়, কম বয়সী অপরিচিত ১০-১২ জন লোক তার পথ আটকায়, পরিচয় জানতে চায়, আর পরিচয় জেনে তার কলার চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় সেই সমবায় আবাসনের অফিসে। সেখানে তখন আরো কিছু অপরিচিত ব্যক্তি, শুরু হয় প্রচণ্ড মারধর, কিল-চড়-ঘুষি-লাথি। তাদের কাছেই অম্বিকেশ জানতে পারে তার অপরাধ—অম্বিকেশ তার কিছু পরিচিত ব্যক্তির কাছে একটি ই-মেল ফরোয়ার্ড করেছিলেন, যাতে একটি কোলাজ-কার্টুন ছিল, সেটি নাকি আপত্তিকর। মার খেতে খেতে প্রাণভয়ে কান্নাকাটি করে অম্বিকেশ তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা করে। নেতা গোছের একজন ছিলেন সেখানে, তিনি তার প্রাণ বাঁচানোর রাস্তা বলে দেন, তারই নির্দেশে অম্বিকেশ মুচলেকা লিখে দিয়ে সে যাত্রায় নিজের প্রাণটা বাঁচান। অম্বিকেশকে প্রাণে ছেড়ে দিলেও তারা তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জমা দেয়, অভিযোগের তলায় অভিযোগকারী নিজের নামের সাথে, সে যে তৃণমূল দলের এক স্তরের নেতা তাও লিখে জানান। তৃণমূলের অভিযোগ পেয়ে, পুলিস তৎপর হয়, অম্বিকেশ মহাপাত্র ও সুব্রত সেনগুপ্ত নামে আরেক ব্যক্তিকে সেই রাতেই গ্রেপ্তার করে। সারা রাত্রি থানায় লক-আপে আটকে রেখে প্রায় ১৯ ঘণ্টা বাদে পরেরদিন তাদের জামিন হয়।

অম্বি‍‌কেশের হয়রানির কিন্তু এখানেই শেষ নয়। পুলিস তাদের বিরুদ্ধে প্রথমে আই পি সি-র ৫০৯, ৫০০, ১১৪ ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬-এ ধারায় মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে ৫০৯ ধারাটিতে আছে মহিলাদের সম্রমহানি করার অপরাধ। বর্তমানে পুলিস, চার্জশিটে ৫০৯, ৫০০, ১১৪ ধারাগুলি বাদ দিয়েছে। এখন পুলিস সাহায্য নিচ্ছে কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি আইনের। এই আইনের ৬৬-এ(বি) ও ৬৬-এ(সি) ধারায় মোট ৯৬ পাতার চার্জশিট পুলিস তাদের বিরুদ্ধে দিয়েছে। অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র ও সুব্রত সেনগুপ্তকে এখন রোজ কোর্টে দৌড়তে হচ্ছে। আলিপুর পুলিস কোর্টে গত ১৩ই আগস্ট, ২৭শে সেপ্টেম্বর ও ২৮শে ফেব্রুয়ারি কেসটা উঠেছে। আবার উঠবে আগামী ২৬শে এপ্রিল। দোষী প্রমাণিত হলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা অনুযায়ী অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র ও সুব্রত সেনগুপ্তর তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।

অম্বিকেশের গ্রেপ্তারের পর, বহু সাধারণ মানুষ, অধ্যাপক, ছাত্র প্রতিবাদে রাস্তায় নে‍‌মেছিলেন। মৃণাল সেনসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি ঘটনার নিন্দা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মানবাধিকার কমিশন অম্বিকেশ মহাপাত্র ও সুব্রত সেনগুপ্তকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে, দোষী পুলিসের শাস্তি ও ওদের প্রত্যেককে ৫০০০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছে। ভারতের প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মার্কণ্ডেয় কার্টুজ রাজ্য সরকারকে মামলা প্রত্যাহার ও অম্বিকেশের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। সাধারণ মানুষ, বিশিষ্ট ব্যক্তি, মানবাধিকার কমিশন বা প্রেস কাউন্সিল—রাজ্য সরকার কারো কোনো কথায় কর্ণপাত করছে না। কিছুদিন আগে রাজ্য সরকার বলেছিল, মানবাধিকার কমিশনকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে এই ব্যাপারে রিপোর্ট দেবে, সেই ৬ সপ্তাহ ১৫ই এপ্রিল, ২০১৩-তে শেষ হচ্ছে, এখনো কিছু জানিয়েছে বলে শোনা যায়নি। সুপ্রিম কোর্টে জনৈক ছাত্রী জনস্বার্থ মামলা করে বলেন যে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারায় সংবিধানে বর্ণিত মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারকে হরণ করছে। সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গসহ চারটি রাজ্যকে এই ব্যাপারে হলফনামা দিতে বলে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা পাত্তাই দেয়নি। এখনো সুপ্রিমকোর্টে তাদের হলফনামা জমা পড়েনি। বোঝাই যাচ্ছে, এই ব্যাপারে, রাজ্য সরকার একেবারেই বেপরোয়া। বরং অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র ও সুব্রত সেনগুপ্তর আরো কি করে হয়রানি করা যায় তার চেষ্টাই চলছে। আর এই কাজে তারা নির্ভর করে আছে কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারার উপর।

এই ৬৬-এ ধারা কি, যার উপর বর্তমান রাজ্য সরকারের পুলিস এত ভরসা করে আছে? এই ৬৬-এ ধারায় আছে যে কোনো ব্যক্তি যদি কম্পিউটার বা অন্য কোনো যোগাযোগকারী যন্ত্রের সাহায্যে (অর্থাৎ, মোবাইলও হতে পারে) আপত্তিজনক (offensive) কোনো কিছু পাঠায়, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপত্তিজনক বলতে তারা ব্যাখ্যা করে বলেছে যা বেশ আপত্তিজনক (grossly offensive)। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন্‌টা আপত্তিজনক আর কোন্‌টাই বা বেশ আপত্তিজনক, তা কে ঠিক করবে? কোন আইনে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অম্বিকেশের পাঠানো কোলাজ কার্টুনটি অনেকেই দেখেছেন, বিখ্যাত চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘সোনার কেল্লা’-র একটি দৃশ্যের অবলম্বনে বানানো ঐ কোলাজ-কার্টুনে কোনো অশ্লীলতা, আপত্তিজনক কিছু বলে কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মনে করছেন, ওটা আপত্তিজনক, তাই পুলিসও আপত্তিজনক হিসাবে ৬৬-এ ধারায় মামলা দায়ের করেছে। এই ঘটনার ব্যাপারে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সভায় ঐ কোলাজ কার্টুনটি সম্বন্ধে নির্দ্ধিধায় বলেছেন, যে ওখানে নাকি তাকে খুন করার কথা বলা হয়েছে। কার্টুনটি যারা দেখেছেন, তারা জানেন, এই কথাটি কতো হাস্যকর। মুখ্যমন্ত্রীর পুলিসও সে কথা বলতে পারেনি, বললে অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রর বিরুদ্ধে তারা খুনের চেষ্টার ধারাই দিতো।

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬-এ(বি) ও ৬৬-এ(সি) ধারায় বলা হচ্ছে, এমন কোনো কিছু যদি পাঠানো হয়, যা বিরক্তি, অসুবিধার কারণ (causing annoyance, inconvenience), তবে তা অপরাধ। কার বিরক্তি, কার অসুবিধা? একজন সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যদি কেউ কিছু ই-মেলে লেখে যা ঐ মানুষটির মনে হতে পারে বিরক্তিকর, অভিযোগ দিলে পুলিস কি প্রেরককে গ্রেপ্তার করবে? এখনো পর্যন্ত ৬৬-এ ধারায় যেসব গ্রেপ্তার হয়েছে, তা হচ্ছে বড় বড় লোকের ব্যাপারে কিছু বলার জন্য। অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র গ্রেপ্তার হয়েছেন তার পাঠানো কোলাজ-কার্টুনে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি ছিল বলে, কেন্দ্রীয়মন্ত্রী চিদাম্বরমের পুত্রকে নিয়ে মন্তব্য করার জন্য একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, বাল থ্যাকারে নিয়ে মন্তব্য করে মহারাষ্ট্রে দুটি মেয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

একটি কোলাজ-কার্টুন অম্বিকেশকে কেউ ই-মেলে পাঠিয়েছিল, অম্বিকেশ তা আবার কাউকে কাউকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, যাদের পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই তাঁর পরিচিত। অম্বিকেশ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে ই-মেল ফরোয়ার্ড করেননি, যা দেখে বিরক্তি হয়েছে বলে কথা উঠতে পারে। যারা অম্বিকেশকে সেদিন মারছিল, তাদের কারোর কাছেই অম্বিকেশ ই-মেল পাঠাননি। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের এই ৬৬এ ধারায় বলা আছে যে আপত্তিকর কিছু পাঠানো অপরাধ, কাকে পাঠানো অপরাধ, তা বলা নেই। কেউ ধরুন, তার একান্ত বন্ধু-পরিজন বা এমনকি তার স্ত্রী বা স্বামীকে ই-মেলে কিছু ব্যক্তিগত আবেগ, মতামত লিখে ফেললেন, যা কোনোমতে জেনে গিয়ে অন্য কারো মনে হলো, ওতে আপত্তিকর কিছু আছে, তা হলেই পুলিসে অভিযোগ জানাতে পারে। বলা বাহুল্য, অভিযোগকারী যদি প্রভাবশালী ব্যক্তি হন, (বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের সদস্য হন, অম্বিকেশের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে), তাহলেই পুলিস অভিযুক্ত ব্যক্তির হয়রানি শুরু করে দেবে।

ই-মেলে কথা চালাচালি, আসলে তো চিঠি লেখার মতো। কেউ যদি চারিদিকে, এমনকি তার অপরিচিত ব্যক্তিদের কাছেও ই-মেলে কোনো আপত্তিকর কিছু যা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর প্রচার করতে থাকে (ধরুন, কেউ যদি সাম্প্রদায়িক উসকানি দিতে থাকে), তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ প্রচলিত আইনেই আছে, দরকারে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে তা ব্যাখ্যা করার জন্যও কোনো আইন বা নিয়মাবলী হতেই পারে। কিন্তু, এমনকিছু হওয়া ঠিক নয়, যা সাধারণভাবে মানুষের অধিকার আছে, কম্পিউটার ব্যবহার করলে যদি তা খর্ব হতে থাকে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬-এ ধারা সংবিধানে বর্ণিত মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারকেই হরণ করছে। সুপ্রিম কোর্টে যিনি জনস্বার্থে মামলা করেছেন, তিনিও এই দাবি করেছেন। মানুষের অধিকারের উপর এ এক সাংঘাতিক আক্রমণ। এই আইন বাতিলের দাবি তাই তুলতেই হবে।

No comments:

Post a Comment